শিরোনাম: |
মি’রাজুনন্নবী : আশিক-মাশুকের মিলনমেলা
মুফতী মুহাম্মদ বখতিয়ার উদ্দীন
|
নবুয়তের দ্বাদশ সাল। রজবের সাতাশতম রজনী। নবীজি ঘুমাচ্ছিলেন উম্মে হানীর ঘরে। ওদিকে জান্নাতের সৌন্দর্যে আনা হল আরো অপরূপ সাজ। আলো ঝলমলে পরিবেশ হয়ে ওঠলো চমৎকার। নানান রঙের ফুলে ফুলে ভরে গেল জান্নাতের পত্রপল্লব। কী যে সুন্দর! অপূর্ব। দোযখের সমস্ত আগুন দফ্ করে নিভে গেল নিমিষেই। থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য আগুনের লেলিহান শিখা। বেহেশ্তের ফেরেশতারা বেহশ্তের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিল আরো বহুগুনে। এসব চলছিল ফেরেশতাকুল সর্দার জিব্রাঈল আমিনের নিখূঁত দিক নির্দেশনায়। আর তা ছিলো মহান রাব্বুল আলামীনের নির্দেশের বাস্তবায়ন। নির্দেশটি ছিলো এমন-’জিব্রাঈল! ফিরিশতাদেরকে বল- যেন সবাই আমার মাহবুবের খিদমতে আনত হৃদয়ে পরিপূর্ণ আদব সহকারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। মিকাঈল রিযিক বন্টনের কাজ আপাতত বন্ধ করো, ইসরাফিল যেন শিঙ্গায় ফুঁক না দেয়, আজরাঈল! আজ রাতে কারো প্রাণ সংহার নিষিদ্ধ। সকল কবরে আযাব বন্ধ করে দেয়া হোক, আদম আলাইহিস সালাম থেকে ঈসা রুহুল্লাহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকলে প্রস্তুত হয়ে যাও নিখিল বিশ্বের প্রেমাস্পদ নবীকুল সর্দার সাহেবে লাওলাকের সাদর সম্ভাষণ জানাতে। কোন রজনী আজ? সকল নবী-রাসূল আজ কাতারবন্দী অপেক্ষার মধুর প্রহর, একটি একটি করে পেছনে ছুটে যাচ্ছে। মহাকাশের নক্ষত্ররাজি আজ আরো বেশি প্রজ্জলিত হয়ে ওঠবে পেয়ারা নবীর নূরানী সান্নিধ্য পেয়ে। মি’রাজ রজনী।
প্রিয়নবীর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মু’জিযা। মহান আল্লাহ্ জিব্রাঈলকে ডাক দিলেন। সত্তর হাজার ফিরিশতা সমেত তুমি বেহেশতে যাও আর একটি বোরাক নির্বাচন করে আমার মাহবুবের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করো-হে আল্লাহ্র হাবীব! আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে সালাম দিয়েছেন। তিনি আপনাকে তার একান্ত সান্নিধ্যে দাওয়াত দিচ্ছেন। আমি এসেছি আপনাকে মেহমান করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মহান আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে জিব্রাঈল বেহেশতে গেলেন। কী যে সুন্দরদৃশ্য! চল্লিশ হাজার বোরাক প্রস্তুত। সুঠাম দেহ আর সৌন্দর্যের বিবেচনায় কোনটিই কম নয়। এ যেন আরেক পরীক্ষা জিব্রাঈলের জন্য। সব বোরাকের একটিই আশা আজ দো’জাহানের বাদশা নবীর খিদমতের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। বাদশাহর বোরাকও শাহী হওয়া চাই। জিব্রাঈল ফিরিশতা, বড় ধাঁধাঁয় পড়ে গেলেন। বোরাক কোনটা রেখে কোনটা নেবেন। সবটাই তো সুন্দর। একবার ভালভাবে দেখে নিলেন সবগুলো বোরাক একপর্যায়ে নজর পড়ল একটি ক্ষীণকায় বোরাকের দিকে যা-কিনা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। বাকীরা আনন্দে লাফালাফিতে ব্যস্ত। জিব্রাঈল ধীরগতিতে সেই বোরাকের নিকটে হাজির। তার ব্যতিক্রম আচরণে জিব্রাঈল আরো কৌতূহলী হলেন। জিজ্ঞেস করলেন-আজ সকল বোরাক খুশীতে আত্মহারা। ব্যতিক্রম কেবল তুমি। সকলের চোখে মুখে হাসি আর তোমার চোখে কান্না! কারণটা খুলে বলবে কী? প্রশ্ন শুনে বোরাকের কান্না আরো বেড়ে গেলো। কান্নাজড়িত কন্ঠে বোরাক বলতে লাগল আজ এখানে চল্লিশ হাজার সুঠাম দেহী সুদর্শন বোরাক উপস্থিত। অথচ, বোরাকের প্রয়োজন কেবল একটা। সুদর্শন আর শক্তিশালী এত বোরাকের মাঝে আমার মত ক্ষীণকায় বোরাকের কোন অস্তিত্বই নেই। মাহবুবে খোদার দুর্লভ সেই খিদমতটা শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ ভেবে কান্নার বিকল্প কোন পথ খোঁজে পেলাম না। বোরাকের সব কথা শুনে জিব্রাঈল বললেন হে সৌভাগ্যবান বোরাক! মন খারাপ করো না। তুমিই সবচাইতে সৌভাগ্যবান। আমি তোমার মধ্যে দু’টি চরিত্র লক্ষ্য করেছি। বিনয় ও নবী প্রেম। আর এ দু’টি চরিত্র আল্লাহ্ ও রাসূলের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হাজারো বোরাকের মাঝে তোমাকেই নির্বাচন করা হলো। বোরাকের চোখে এবার খুশীর বন্যার ঝর্ণাধারা। তার ভাগ্যাকাশ চমকে ওঠলো। দুর্বল, ক্ষীণকায় তাতে কী? নবীর পরশে দুর্বল ও সবল হয়ে যায়, মৃত জিন্দা হয়ে যায়, হতভাগা হয়ে যায় খোশ নসীব। বোরাকের বিনয় এবং প্রেম তার মর্যাদাকে নিয়ে গেলো সৌভাগ্যের চরম শিখরে। জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বোরাককে নিয়ে হাজির নবীজির দরবারে। দেখলেন নবীজি বিশ্রাম নিচ্ছেন, ঘুম ভাঙ্গিয়ে কিছু বলবেন এতটুকু সাহস হলো না জিব্রাঈলের। ওদিকে খোদার হুকুম- ‘তাড়াতাড়ি আমার বন্ধুকে নিয়ে এসো। জিব্রাঈল বললেন ওহে রাজাধিরাজ! তাড়াতাড়িতো নিশ্চয়। কিন্তু আপনার মাহবুব নবী যে আরাম করেছেন। ডাকলে বেআদবী হতে পারে। রাব্বুল আলামীন! সহজ পন্থাটুকু বাতলিয়ে দিলে আমার উপর মেহেরবানী হয়। হুকুম আসল -ইয়া জিব্রাঈল! কাব্বিল কাদমাইহি জিব্রাঈল! আমার মাহবুবের কদমে পাকে চুম্বন করো! যেমন নির্দেশ তেমন বাস্তবায়ন। জিব্রাঈল নবীজির কোমল শীতলতা অনুভব করলেন। চক্ষুযুগল খুললেন। আর জিজ্ঞাসা করলেন, জিব্রাঈল! এত গভীর রজনীতে আপনার আসার উদ্দেশ্য কী? জবাবে জিব্রাঈল বললেন- আমি আসিনি; আমাকে পাঠানো হয়েছে। পাঠানো হয়েছে আপনাকে মেহমান করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাঠিয়েছেন কুল কায়েনাতের প্রভু। তিনি আজ আপনাকে তাঁর দরবারের একমাত্র মেহমান হিসেবে দাওয়াত দিয়েছেন। আট বেহেশত সাজানো হয়েছে। অপরূপ সাজে। ফিরিশতারা সাত আসমানও করেছে অনন্য রূপ সৌন্দর্যে সজ্জিত। আপনিই কেবল আরশের দুলা। লা-মকানের অদ্বিতীয় মেহমান, বাদশায়ে দু’জাহান, মাহবুবে কিবরিয়া নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহূ তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানীর ঘর থেকে ওঠে প্রস্ততি নিতে শুরু করলেন। জিব্রাঈল নবীজিকে মক্কার উপত্যকায় নিয়ে গেলেন যেখানে অপেক্ষমান ছিলেন মিকাঈল ইসরাফিলসহ সত্তর হাজার ফিরিশতা। সেখানেই নবীজির সামনে পেশ করা হলো বোরাক নামক বেহেশতী বাহন। মিশকাত এর বর্ণনায় দেখা যায়, বোরাক খচ্ছরের চেয়ে একটু ছোট আকারের, আর গাধার চেয়ে বড় আকৃতির একটি প্রাণী বিশেষ। জিব্রাঈল বোরাকে আরোহণের জন্য নবীজির কাছে আবেদন করলে তিনি একটু সামনে গিয়ে আবার থমকে গেলেন। কারণ, মনে পড়ে গেলো উম্মতের কথা। প্রিয় মাহবুবের আগমনের অপেক্ষায় অপেক্ষমান রাব্বুল আলামীন জিব্রাঈলকে ডাক দিয়ে বলেন - আমার হাবীবের থেমে যাওয়ার রহস্যটা একটু আদবের সাথে জেনে নাও। জিব্রাঈল নবীজির দরবারে আরজ করলেন -কোন চিন্তা আপনাকে বিচলিত করেনিতো? নবীজি জবাব দিলেন, আজ আমার জন্য মহা সৌভাগ্যের রজনী। মহান রাব্বুল আলামীন আমাকে কত ইজ্জত-সম্মান দিয়ে লা-মকানের মেহমান করে নিয়ে যাচ্ছেন আমার সম্মানে আজ সাজানো হলো জান্নাতুল ফেরদাউসসহ সাত আসমান। আরো কত কি? কিন্তু কিয়ামতের কঠিন ময়দানে আমার উম্মতেরা যখন ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত অবস্থায় গুনাহের বোঝা নিয়ে কবর থেকে ওঠবে পঞ্চাশ হাজার বছরের কঠিন সময় কিভাবে পার করবে আর চুলের চাইতে চিকন, তরবারীর চাইতে ধারালো ত্রিশ হাজার বছরের রাস্তা পুলসিরাত কীভাবে অতিক্রম করবে? সে চিন্তায় আজ আমি অস্থির! রাব্বুল আলামীন সাথে সাথে ডাক দিলেন ওহে আমার প্রিয় হাবিব! আপনি এইসব চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি আজ আরশের দুলা, লা-মকানের মেহমান। আজকের দিনে আপনার মনে পেরেশানী থাকবে তা কিছুতেই হতে পারে না। আজকে যেভাবে আপনাকে বোরাক পাঠিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে, ঠিক সেভাবে কিয়ামত দিবসে আপনার আশেক উম্মতের জন্য পুলসিরাত পার হওয়ার জন্য বাহন পাঠিয়ে দেয়া হবে। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বর্ণনায় দেখা যায়-মু’মিন মুত্তাকীদের কিয়ামত দিবসে বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে ওঠানো হবে। পরিশেষে নবীয়ে দু’জাহা মেহমানে লা-মকাঁ যেই মাত্র বোরাকে আরোহণ করতে যাচ্ছেন, অমনি বোরাক একটু নড়াচড়া দিয়ে ওঠলো আর নবীজির দরবারে আরজ করলো, মহান আল্লাহর দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, আজকের এ শুভ মুহূর্তে আপনার খিদমত করার জন্য আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। আপনার কদমে পাকে আমার একটাই আবেদন, আজ যেভাবে আপনি আমার পিঠে আরোহন করবেন, কিয়ামত দিবসেও যেন আপনার খিদমত করার সুযোগ পাই। সেদিন আপনি যেন আমাকে ভুলে না যান। সেদিনও যেন আমাকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করেন। নবীজি বললেন, বোরাক! মন খারাপ করো না তোমার আবেদন আমি মঞ্জুর করলাম। কিয়ামত দিবসে আমি তোমার পিঠে আরোহন করবো।এবার লা-মকানের মেহমান চড়ে বসলেন বোরাকের পিঠে। একপাশে জিব্রাঈল অন্যপাশে মিকাঈল। আর যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত পরিব্যপ্ত সেই নূরের মিছিল। সবার চোখে মুখে যেন ঈদের আমেজ। নূরের জুলূছে নূরের নবী! যার সৌন্দর্য যেন কল্পনার জগতকে হার মানিয়েছে। শূণ্যাকাশের পথ বেয়ে চলছে এ অপূর্ব মিছিলটি দেখতে দেখতে পৌছে গেলেন আরবের সবুজ শ্যামল একটি জনপদে। জিব্রাঈল বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ এখানে আমরা একটু যাত্রা বিরতি করবো। আপনি দু’রাকাত নামাজ পড়ে নিতে পারেন। এটা আপনার হিজরতের স্থান। এ শহরের নাম ‘ইয়াসরব’। নবীজি বোরাক থেকে নেমে সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর পুণরায় সফরে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সফরের মাঝ পথে নবীজি আরো যিয়ারত করলেন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর মাযার শরীফ। তিনি ইরশাদ করেন- আমি দেখতে পেলাম মুসা আলাইহিস সালামকে কবরে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। এখানে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়। প্রথমত: নবীজি যমীনের উপর যেমন দেখেন ভিতরেও সমান দেখতে পান। দ্বিতীয়ত: মুসা আলাইহিস সালাম কবরের মধ্যে জীবিত এবং সক্রিয়। নবীগণ আপন আপন মাযার শরীফে জীবিত তা আরো একবার প্রমাণিত হয়ে গেলো। যারা বলে নবী মরে মাটির সাথে মিশে গেছে, তাদের আক্বীদা ভ্রান্ত। এরপর নূরের বহর পৌছে গেলো বাইতুল মুকাদ্দাস। জিব্রাঈল বোরাক বাঁধলেন একটি পাথরের সাথে। আগে-থেকে অপেক্ষারত অসংখ্য ফিরিশতা সমস্বরে বলে ওঠলেন, আসসালামু আলাইকুম ইয়া আউয়ালু ইয়া আখিরু, ইয়া হাশেরু। তাঁদের সালাম শুনে নবীজি জিব্রাঈলকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরা আমাকে এই ভাষায় সালাম দেয়ার কারণটা কি? জিব্রাঈল বললেন-আপনাকে ইয়া আউয়ালু এ জন্য বলেছেন কেননা আপনি সর্বপ্রথম শাফায়াত করবেন আর ইয়া আখিরু এই জন্য বলেছেন যেহেতু আপনি শেষ নবী তথা খাতামুন্নবীয়িন। আর ইয়া হা-শেরু বলার কারণ হল কিয়ামত দিবসে কবর থেকে যারা উঠবে তাদের মধ্যে আপনিই সর্বপ্রথম। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহূ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি আদম সন্তানদের সর্দার আমিই সর্বপ্রথম রওজা শরীফ হতে ওঠব এবং সর্ব প্রথম শাফায়াত করব এবং সর্বপ্রথম আমার শাফায়াত কবুল করা হবে। এবার নবীজি জিব্রাঈলসহ মসজিদে আকসায় প্রবেশ করেন। সেখানে পূর্ব হতেই লক্ষ লক্ষ নবী রাসূল অপেক্ষায় ছিলেন। আজান হল। নামাযের জন্য সবাই কাতারবন্দি। কে ইমামতি করবেন? একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এমন সময় জিব্রাঈল আমিন নবীজির হাত মোবারক ধরে ইমামতির মুসাল্লায় দাঁড় করিয়ে দিলেন নবীজির ইমামতিত্বে সকল নবী-রাসূল দু’রাকাত নামায আদায় করলেন, নামায শেষে সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনা সভার আয়োজন। প্রসিদ্ধ নবী-রাসূলগণ একে একে বক্তব্যও রাখলেন সেই সংবর্ধনা সভায়। প্রথমে আদম আলায়হিস সালাম’র পালা। এরপর যথাক্রমে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম, হযরত মুসা আলায়হিস সালাম, হযরত দাউদ আলায়হিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলায়হিস সালাম, হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম বক্তব্য পেশ করলেন। পরিশেষে, নবীকুল সরদার আকায়ে নামদার লা মকানের মেহমান আহমদ মোজতবা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহূ তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সকল নবী-রাসূলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন।সকল প্রশংসা বিশ্ব জগতের প্রভূর! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সেই মহান সত্তার যিনি আমাকে উভয় জগতের জন্য রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছেন। সকল সৃষ্টির জন্য নবী করে পাঠিয়েছেন। সারা দুনিয়ার জন্য বশীর ও নযীর করে পাঠিয়েছেন, আমাকে প্রদান করা হয়েছে পবিত্র কুরআন মজিদ; যার মধ্যে রয়েছে সকল কিছুর বর্ণনা। আমাকে কুরআন মজিদে ‘মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহূ তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আর ইঞ্জিল কিতাবে ‘আহমদ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পূর্ববর্তী অন্যান্য কিতাবে হামেদ আর যবুর কিতাবে ডাকা হয়েছে ‘মাহমুদ’ করে। নবীজির দীর্ঘ বক্তব্য শেষে হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস সালাম বলে ওঠলেন, এই জন্য ইনি তোমাদের সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আ‘লা হযরতের ভাষায়- সবছে আওলা ওয়া আ’লা হামারা নবী সবছে বালা ওয়ালা হামারা নবী। খলকছে আউলিয়া আউলিয়াছে রাসূল আওর রাসূলুঁছে আ’লা হামারা নবী। মসজিদে আকসা তথা বাইতুল মুকাদ্দাস হতে শুরু হয় উর্ধ্বকাশে রওয়ানা। প্রথম আসমানে গিয়ে জিব্রাঈল ডাক দিলেন, দরজা খোল। ভিতর হতে আওয়াজ আসল কে আপনি? বললেন- আমি জিব্রাঈল। আপনার সাথে কে? বললেন আমার সাথে নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহূ তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। (মিশকাত ৫২৯ পৃষ্ঠা) প্রথম আসমানে সাক্ষাৎ হল হযরত আদম আলায়হিস সালাম এর সাথে। তিনি নবীজিকে সাদর সম্ভাষণ মোবারকবাদ ইত্যাদি পেশ করলেন এবং কথোপকথন চলল কিছুক্ষণ এবার গেলেন দ্বিতীয় আসমানে। সেখানে সাক্ষাৎ হল হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম এবং হযরত ইয়াহিয়া আলায়হিস সালাম এর সাথে তৃতীয় আসমানে সাক্ষাৎ হল হযরত ইউনুস আলায়হিস সালাম এর সাথে, হযরত ইদ্রিস আলায়হিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ হল চতুর্থ আসমানে, পঞ্চম ও ষষ্ঠ আসমানে যথাক্রমে হযরত হারুন আলায়হিস সালাম ও হযরত মুসা আলায়হিস সালাম আর সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস সালাম এর সাথে।এখানে মজার ব্যাপার হল- যে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর সাথে প্রথমে দেখা হয়েছিল কবর শরীফে, সেই মুসা আলায়হিস সালাম এর সাথে আবার দেখা হল বাইতুল মুকাদ্দাসে, আবারও হল ষষ্ঠ আসমানে। একজন নবী হযরত মুসা আলায়হিস সালাম যদি একই মুহূর্তে তিন জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে যিনি নবীকুল সর্দার, তাঁর ক্ষমতা কতটুকু হতে পারে তা প্রশ্নাতীত। তাইতো সুন্নী আক্বীদা হল নবী হাযির-নাযির; হায়াতুন্নবী। ওহাবী, তবলীগি, মওদুদী তথা বাতিলপন্থিরা বিষয়টি একটু গবেষণা করলেই বোধ হয় সঠিক রাস্তা পেয়ে যেত। বিশাল জগত পাড়ি দিয়ে এবার সিদরাতুল মুনতাহা। জিব্রাঈল আলায়হিস সালামের ক্ষমতা এখানেই শেষ। কিন্তু যেতে হবে সামনে আরো বহু পথ। হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বিনয়ের সাথে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ঠিকানা এখানেই শেষ। সামনে এক কদম যাওয়ারও ক্ষমতা আমার নেই। সামনে নূরের জগত। আপনিই একমাত্র যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এক চুল পরিমাণ সামনের দিকে এগোলে নূরের তাজাল্লীতে আমার সত্তর হাজার ডানা পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। নবীজি কোন প্রকার বিচলিত হলেন না বরং হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস সালামকে সেখান থেকে বিদায় দিয়ে নূরের জগতের উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। যাওয়ার প্রাক্কালে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি তো মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করব। তো আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন, আজ যেভাবে আপনার খেদমত আঞ্জাম দিয়েছি তেমনি কিয়ামত দিবসে আপনার উম্মতেরা যখন পুল সিরাত পার হবে তখন আমি যেন তাদের পায়ের নিচে আমার ডানা বিছিয়ে দিতে পারি। এরপর হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস সালামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন লা-মকানের মেহমান দু’জাহানের বাদশা কামলিওয়ালা নবী সাল্লাল্লাহূ তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। সামনে সত্তর হাজার নূরের হিজাব একেকটা নূরের হিজাব পাঁচশত বছরের পথ। নবীজি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেন। লা-মকান থেকে আওয়াজ আসছে ‘উনদু মিন্নী ’ আপনি আরো কাছে আসুন! নবী আরো কাছে গেলেন। আবার আওয়াজ আসল আরো কাছে আসুন। নবীজি আরো কাছে গেলেন। এক পর্যায়ে নবীজি মহান রবের নূরানী তাজাল্লীর সাথে একাকার হয়ে গেলেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায় নবীজি রাব্বুল আলামীনের এতই নিকটে গেলেন যেন দুই ধনুকের মাঝখানে অবস্থান করছেন। এরপর শুরু হল হাবিব-মাহবুবের (প্রেম-প্রেমাস্পদের) মুহাব্বতের একান্ত আলাপ। নব্বই হাজার কথাবার্তা হয়ে গেল। সময় কাল সবকিছু স্তদ্ধ, সমগ্র প্রকৃতি নীরব, নিথর, একপর্যায়ে বিদায়ের পালা। নবীজি ধরার বুকে আবার ফিরে আসবেন আসার সময় আল্লাহ্ পাক পুরস্কার দিলেন উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায, পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হযরত মুসা আলায়হিস সালাম এর সাথে। তিনি অনুরোধ করলেন নামাযের সংখ্যা আরো একটু কমিয়ে আনার জন্য। নবীজি আল্লাহর দরবারে বার-বার গিয়ে ৪৫ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসলেন। কিন্তু সওয়াব বরাবর। উল্লেখ্য যে, নবীজির মিরাজ বিশাল রহস্যাবৃত একটি ঘটনা; যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। নবীজি কিভাবে গেলেন তার বর্ণনা পাওয়া গেলেও কিভাবে আসলেন তার কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝা গেল, আসার সময় কোন বোরাকের প্রয়োজন হয়নি। আসার সময় যদি কোন বাহনের প্রয়োজন না হয় তাহলে যাওয়ার সময় কেন প্রয়োজন হল? বুঝা গেল নবীজি মহান আল্লাহর দরবারে যাওয়ার জন্য নিজেই যথেষ্ট। যা কিছুর আয়োজন করা হয়েছে সব তাঁর সম্মানে। পবিত্র হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নবীজি যাওয়ার প্রাককালে যে পানি দ্বারা উযু করেছিলেন, সে পানি ফিরে এসে দেখলেন গড়াগড়ি করছে। ঘরের দরজায় আটকানো শিকল এখনো নড়াচড়া করছে। অর্থাৎ নবীজির দুনিয়ার বুকে থেকে উর্ধ্বাকাশে রওয়ানার সাথে সাথে জগতের সকল কিছুর গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ, তিনি সৃষ্টি জগতের প্রাণ বা রূহ। তিনি রাহমাতুল লিল্ আলামীন। |